তাপ এক ধরনের শক্তি এবং আমাদের নানা কাজে আমরা এই তাপ শক্তিকে ব্যবহার করি। কোনো কিছু সঠিকভাবে ব্যবহার করতে হলে সেটাকে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় নিতে হয়। কাজেই তাপশক্তিকে আমাদের এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় নিতে হয় কিংবা সঞ্চালন করতে হয়। তিনটি উপায়ে তাপ সঞ্চালন করা হয় সেগুলো হচ্ছে তাপের পরিবহন, পরিচলন এবং বিকিরণ।
পরিবহন: আমরা সবাই রান্না করা বিষয়টির সঙ্গে পরিচিত। তোমরা সবাই দেখেছ রান্না করার জন্য চুলার আগুনের ওপর একটি ডেকচি রাখা হয় এবং আগুনের উত্তাপ ডেকচির মাধ্যমে পরিবহন হয়ে ডেকচির ভেতর যা কিছু আছে তাতে সঞ্চালিত হয়। আমরা সবাই দেখেছি, তাপ যেন ঠিকভাবে সঞ্চালিত হতে পারে, সেজন্য দেখছি ডেকচিগুলো তাপ পরিবাহী পদার্থ দিয়ে তৈরি হয়।
আমরা যেহেতু জেনে গেছি কঠিন পদার্থের বেলায় তাপ হচ্ছে অণুগুলোর কম্পন তাই এবারে আমরা খুব সহজেই তাপের পরিবহন বুঝতে পারব। যখন কঠিন পদার্থের এক প্রান্ত উত্তপ্ত করা হয়, তখন সেই প্রান্তের অন্যগুলো নিজের জায়গা থেকেই কাঁপতে থাকে। তোমরা কল্পনা করতে পারো একটি অণুর সঙ্গে অন্য অণু একটা স্প্রিং দিয়ে যুক্ত। তাই একটা অণু কাঁপতে থাকলে সেটি তার পাশের অন্য অণুকেও কাঁপাতে শুরু করে। সেই অণুটি তখন তার পাশের অণুকে কাঁপায়। এভাবে কম্পনটি কঠিন পদার্থের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে পরিবাহিত হয়।
পরিচালন: তুমি যদি কেটলিতে পানি রেখে চুলায় সেটা গরম করো, তাহলে কিছুক্ষণের মধ্যে সেটা ফুটতে শুরু করে। কেটলির সমস্ত পানি উত্তপ্ত হওয়ার জন্য কিন্তু তাপের পরিবহন প্রক্রিয়া কাজ করে নি। তোমরা যারা গ্রীষ্মের দুপুরে পুকুরের পানিতে ঝাঁপ দিয়েছে তারা সবাই লক্ষ করেছ পুকুরে পৃষ্ঠদেশের পানি মোটামুটি উত্তপ্ত হলেও পুকুরের নিচের পানি কিন্তু যথেষ্ট শীতল। পুকুরের পানি যদি পরিবহন পদ্ধতিতে গরম হতো তাহলে পৃষ্ঠদেশ থেকে ধীরে ধীরে নিচের পানিও গরম হতে শুরু করত।
তরল পদার্থের বেলায় সেটি গরম হওয়ার সময় ভিন্ন একটি প্রক্রিয়া কাজ করে থাকে, সেটির নাম হচ্ছে পরিচলন। এই পদ্ধতিটি বোঝার আগে আমাদের আরও একটি বিষয় জানতে হবে, সেটি হচ্ছে তরল কিংবা গ্যাসকে উত্তপ্ত করা হলে তার ঘনত্ব কমে সেটি হালকা হয়ে যায়। আমরা এখন তার কারণটাও ব্যাখ্যা করতে পারব। কোনো তরল যদি উত্তপ্ত করা হয়, তাহলে তার অণুগুলোকে আরো বেশি বেগে ছোটাছুটি করতে হয় বলে তার বেশি জায়গার প্রয়োজন হয়—কাজেই একই পরিমাণ তরল একটু বেশি জায়গায় নিয়ে থাকলে তার ঘনত্ব কমে যায় বা সেটি হালকা হয়ে যায়। কাজেই কেটলিতে পানি গরম করার সময় কেটলির তলায় স্পর্শ করা পানি উত্তপ্ত হয়ে ওঠে উপরে উঠে যায়, তখন পাশের শীতল পানিও সেখানে উপস্থিত হয়। এভাবে পানির ভেতর একটা অভ্যন্তরীণ পরিচলন শুরু হয়, সেটি সকল পানিকে খুব ভালোভাবে মিশিয়ে পানিকে উত্তপ্ত করে।
গ্যাস উত্তপ্ত হলে হালকা হয়ে যায়, আমরা সেটা আগুনের শিখার দিকে তাকালেই বুঝতে পারি। সব আগুনের শিখা সব সময় উপরের দিকে উঠে। আগুনের শিখা হচ্ছে উত্তপ্ত জ্বলন্ত গ্যাস, কাজেই সেটি হালকা হয়ে উপরে উঠে। তুমি কখনো আগুনের শিখাকে অন্য কোনোদিকে ছড়াতে দেখবে না, শুধু ভরশূন্য মহাকাশযানে আগুনের শিখা উপরের দিকে না উঠে চারপাশে সমানভাবে ছড়িয়ে পড়ে।
বিকিরণ: আমরা যদি জ্বলন্ত আগুনের পাশে দাঁড়াই, তখন এক ধরনের তাপ অনুভব করি। এই তাপটি পরিবহনের মাধ্যমে তোমার কাছে আসেনি, পরিচালনার মাধ্যমেও আসিনি। আমরা যখন রোদে দাঁড়াই, তখন যে তাপ অনুভব করি, সেই তাপও পরিবহন কিংবা পরিচলন পদ্ধতিতে সূর্য থেকে তোমার কাছে পৌঁছায়নি, এই তাপ সঞ্চালনের পদ্ধতির নাম বিকিরণ।
তোমরা আগের শ্রেণিতে দৃশ্যমান আলোর সঙ্গে সঙ্গে অদৃশ্য আলোর কথা পড়েছিলে। এই অদৃশ্য আলোর অবলাল অংশটুকুর একটা অংশ আমরা চোখে না দেখলেও তাপ হিসেবে অনুভব করতে পারি। কাজেই যখন আমরা আগুনের পাশে দাঁড়াই তখন আমরা সেই অদৃশ্য তাপরশ্মিকে অনুভব করেই সেটাকে আমরা বিকিরণ বলে থাকি। বিকিরণের জন্য কোনো মাধ্যমের দরকার হয় না, সেজন্য সূর্য আর পৃথিবীর ভেতরে মহাশূন্য থাকার পরেও দৃশ্যমান আলোর সঙ্গে অদৃশ্য অবলাল রশ্মি এবং অতিবেগুনি রশ্মি পৃথিবীতে চলে আসতে পারে।
Read more